হাটিরপাড়। আমার গ্রাম। ছোট্ট একটি গ্রাম। গ্রামে খেলার মাঠ ছিলো। ছিলো গাছগাছালি। আম, জাম, কাঁঠালসহ অনেক গাছ। প্রত্যেক বাড়ির সামনে উঠানও ছিলো। বিকেল হলে উঠানে সবাই জড়ো হতো। গল্প করতো। ঝগড়াও হতো নিয়মিত। এক পরিবারের সাথে আরেক পরিবারের। আবার নিমিষেই মিলিয়েও যেত। ছেলেরা দল বেঁধে গল্প করতো। নানা ধরনের গল্প। পড়াশুনার গল্প, শিক্ষকের পিটুনি খাওয়ার গল্প, সিনেমা দেখার গল্প, খেলাধুলার গল্প। গল্পের শেষ নেই। বন্ধের দিনগুলোতে উঠানেই লাটিম খেলতো। ছেলে মেয়েরা মিলে গোল্লা ছুট খেলতো, দাঁড়িয়াবান্ধা খেলতো। ফুটবলের একটি দলও ছিলো। হাটিরপাড় ফুটবল একাদশ। প্রতি শুক্রবার এক এক দলের সাথে খেলা হতো। কখনো ঘোষপাড়ার সাথে। কখনোবা হাসপাতালপাড়ার সাথে। বাবু ভাই খুব ভালো খেলতেন। মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে গোল করতেন। কখনো মিডফিল্ড থেকে এক কিকেই গোল দিতেন। গোলগাল চেহারা ছিলো বাবু ভাইয়ের। দৈর্ঘ্যে ছিলেন মাঝারি। শ্যাম বর্ণের। চুলগুলি ছিলো ভীষণ ঘন। নাকটা ছিলো লম্বা। খেলাধুলার সাথে গল্পেও ছিলেন সেরা। গল্পের ডালি নিয়ে বসতেন। একেক দিন একেক ধরনের গল্প। গল্প করতেন আর সবাইকে হাসাতেন। নিজেও হাসতেন। হাসার সময় বাবু ভাইয়ের মসৃণ সাদা দাতগুলিও হেসে উঠতো।
বাবু ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব ছিলো মজনু ভাইয়ের। একই দলে খেলতেন। উনি খেলতেন ডিফেন্সে। খেলার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো মজনু ভাইয়ের। নিজের টাকা দিয়ে সবাইকে খাওয়াতেন। খেলায় অংশগ্রহণের টাকার বেশির ভাগই উনি দিতেন। একবার হারলে জেদের বশে আবার খেলতেন। না জেতা অবধি সবাইকে জোর করে খেলাতেন। সম্পর্কে মজনু ছিলো আমার ভাতিজা। তবে ভাই বলেই ডাকতাম। পূর্বের অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি। সময়টা ছিলো ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮ এর মাঝামাঝি। ওই সময় সবার বাড়িতে টিভি ছিলো না। হাতে গোনা কয়েকটি টিভি ছিলো। মজনু ভাইদের বাড়িতে একটি বিহারী পরিবার থাকতো। এখনও মনে পড়ে; বিহারীরা যখন উর্দুতে কথা বলতো আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতাম। তাদের বাড়িতেই তারা খেলা দেখতেন। আমাদের বাড়িতে খেলা দেখতে আসতেন বাবু ভাইয়েরা। বিশ^কাপ ফুটবলের সময় রাত অবধি খেলা দেখতেন সবাই। বাবু ভাই, বাবলু ভাই, তাজুল ভাই, মুকুল ভাই, মাজেদ, ফারুকসহ আরোও অনেকে। ঘরের ভেতর থেকে টিভি বাইরে এনে রাখতেন আমার বাবা। বোনো ভাই, শহিদুল ভাইও আসতেন খেলা দেখতে। ওনারা ভালো খেলতে পারতেন না। তবে ভালো ফুটবল বুঝতেন। আমার বড় ভাইয়ের সাথে তাদের নিবিড় বন্ধুত্ব ছিলো। অবশ্য বোনো ভাইকে আমরা চাচা বলে ডাকতাম। বোনো চাচা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন উনি। খেলা দেখা শেষে বিপ্লব ভাইয়ের বেডেই থাকতেন। এক রুমে দুটো বেড ছিল। এক বেডে থাকতেন বিপ্লব ভাই ও বোনো চাচা। আর এক বেড়ে থাকতাম আমি আর আমার মেজো ভাই রন্জু। মাঝে মাঝে শহিদুল ভাইও তাদের সাথে গাদাগাদি হয়ে থাকতেন। রনজু ভাই খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। জেলা স্কুলের অধিনায়ক ছিলেন। বিকেএসপির ক্যাম্পেও ছিলেন কয়েকদিন। কিন্তু কেন ভর্তি হতে পারেন নি তা জানতে পারি নি। অবশ্য তখন জানার আগ্রহটা ওইভাবে তৈরি হয় নি। বোনো চাচা বিপ্লব ভাইকে বলতেন খেলার পরিকল্পনাগুলি। কিভাবে অন্যান্য দলগুলোকে হারাবে। গভীর রাত অবধি চলতো তাদের আলোচনা। তিনি যে টিম ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করেছিল এখন তা বুঝতে পারি। বোনো চাচা অসাধারণ ঘুড়ি উড়াতেন। মাঝে মাঝে বড় বড় ঘুড়ি উড়াতেন। তার ঘুড়ি উড়তো আকাশের দূর সীমানা অবধি। আমরা সবাই তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মাথা উঁচু করে দেখতাম তার ঘুড়ি উড়ানোর দৃশ্য। সবার ঘুড়ি কাটা পড়লেও তার ঘুড়ি পড়তো না। ঘুড়ির রাজ্যে তিনিই ছিলেন স¤্রাট। ঘুড়িতে সুতো ধার দিতেন তিনি প্রচুর সময় ধরে। কোথা থেকে বর্ণিল সব ঘুড়ি নিয়ে আসতেন বলতেন না। সবাইকে একটা ঘোরের মধ্যে রাখতেন। বোনো চাচা দেখতে ছিলেন খাটো। ধবধবে ফর্সা মুখে ছিলো ছোপছোপ দাগ। শরীরে তেমন মাংসও ছিলো না। একদম লিকলিকে। চুল ছিলো কোকড়ানো। আর ছোট ছোট চোখগুলি ছিলো গর্তের ভেতরে ঢোকানো। পড়াশুনা তেমন করেন নি। ছোটবেলা থেকেই কাজ করতেন মোটর মেকানিকের দোকানে।
সে সময় ভালো খেলোয়াড়ের সাথে দর্শকও ছিলো। হাটিরপাড় দলের নিজস্ব দর্শক। খেলার সময় তারাও যেত দলের সাথে। বোনো চাচাই নিয়ে যেতে উৎসাহিত করতেন। এদের মধ্যে উজ্জ্বল ছিলো প্রথম সারির দর্শক। দর্শক হলেও ভালোই খেলতো ও। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় দলে সুযোগ পেতো না। রাজপুত্রের মতো চেহারা ছিলো উজ্জ্বলের। ওর মা যে পরিচ্ছন্নতা কর্মী সেটি বিশ^াস করার উপায় নেই। ওর মাও ছিলেন অসম্ভব বিনয়ী। প্রতিদিন ভোরবেলা রাস্তা ঝাড় দিতেন উনি। চাচি বলেই ডাকতাম আমরা তাকে। উজ্জ্বলের বাবা কোথায় থাকতো আমরা তা জানতাম না। একদিন জিজ্ঞেস করতেই ও হু হু করে কেঁদেছিলো। এরপর আরা এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করি নি আমরা। ওর মার কাছেই থাকতো উজ্জ্বল। উজ্জলের মতো বাবুদাদাও ভালো ফুটবল খেলতেন। কিন্তু অতিরিক্ত মোটা হবার কারণে অল্পতেই হাঁপিয়ে পড়তেন। তাই নিজে থেকেই দর্শক বনে যেতেন। লম্বায় যেমন দীর্ঘ ছিলেন মোটাও ছিলেন অনেক। দাদার গায়ের রং ছিলো তার কোকড়ানো ঘন চুলের মতোই কালো। প্যান্টের সাথে টি শার্ট ইন করে পড়তেন। আর হেলেদুলে হাঁটতেন। প্রথম প্রথম আমরা যখন তাকে দেখতাম ভয় পেতাম। পরে যতই দাদার যতই কাছে যাই ততই আবিস্কার করি তার সরলতা। তখন আমি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তাম। বাসায় আসলে যখনই দেখা হতো বাবুদার সঙ্গে কুশল বিনিময় হতো আমাদের। জোর করে চা খাওয়াতো। বলতো, তোরা হোলি আমাদের এলাকার গর্ব। তোরা ভালো কিছু করলেই তো আমাদের ভালো লাগবে। আবার পরে যেন ভুলে যাস নে ভাই। ছোট্ট রিজুও ছিলো বাবুদা ও উজ্জ্বলের মতো প্রথম সারির দর্শক। বয়সে আমার চেয়েও ছোট। খেলতে পারতো না রিজু। পোলিও রোগি ছিলো ও। ছ্ােট বেলা থেকেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলেও ওর সাথে হেঁটে কেউ পারতো না। বিশেষত খেলতে যাওয়ার দিন ওর হাঁটার গতি ছিলো তীব্র। এমনকি অন্যান্যরা আস্তে হাঁটলে রিজু ধমক দিতো। বলতো তোমরা জোরে হাঁটো। তোমাদের পায়ে তো বল নাই। কিভাবে খেলবে? হাঁটতেই তো পারো না। নিজের বড় ভাই রাজুকেও বলতে ছাড়তো না রিজু। মায়াবী চেহারা ছিল রিজুর। মুখখানা ছিলো সরু। শ্যাম বর্ণের। চোখদুটি ছিলো বড় বড়। পাশাপাশি চোখের ভ্রæ ছিলো ঘন। গাড় ঘন। আমাকে শাসিয়ে বলতো, মন্জু চাচা, তুমি বল তুলে মারতে পারো না কেন? তোমার ট্রেনিং লাগবে। আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকতাম। রিজুর বাবাও ছিলেন রিজুর মতো কমেডি। লÐ্ররি কাজ করতেন। সম্পর্কে আমার ভাই হতো। এলাকার প্রত্যেকই তার সাথে ইয়ার্কি করতো। কখনোই বিরক্ত হতেন না তিনি। বরং সন্তানতুল্য ছেলেদের আনন্দ দিতেন। তার নাম ছিলো ফরিদ। গ্রামের ছোট বড় সবার কাছেই ফরিদ ভাই হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ফরিদ ভাইয়েরা চারভাই মিলেই থাকতেন একসাথে। সামান্য পরিসরের একটি জায়গায়। মিলে মিশেই থাকতেন। তাদের বাড়ীর সামনের জায়গাটা ছিলো ফাঁকা। ফাঁকা জায়গায় একটা মাঝারি গড়নের আম গাছ ছিলো। ওই গাছের আম মিষ্টি হওয়ায় গ্রামের সব ছেলেরাই টার্গেট করতো। আম পাড়তে গেলেই ফরিজন বুড়ি চেঁচিয়ে গ্রাম তোলপাড় করতো। তাদের বাড়ীর পূর্ব দিকেই থাকতেন হ্যালপেশু চাচা। তার গাছের আমগুলিও ছিলো মিষ্টি। তার গাছের পাকা আম রাস্তায় পড়ামাত্রই আমরা কুড়িয়ে নিতাম।
ফরিদ ভাইয়ের সাথে খুব ভাল সখ্যতা ছিলো এনামুলের। এনামুল আমার বন্ধু। আমরা এক স্কুলেই পড়েছি। এনামুলও খুব ভালো ফুটবল খেলতো। ওর ভাতিজার নাম লাভলু। লাভলু ও লাকু ওরা দুই ভাই। লাকু ফুটবল খেললেও লাভলু খেলতে পারতো না। তবে খুবই ভদ্র ছিলো। চেহারার মাঝেও বিনয় ভাব ছিলো লাভলুর। ছোটবেলা থেকেই লাভলু আমাকে বাবা বলে ডাকতো। যেহেতু এনামুলকে বাবা বলে ডাকে তাই আমাকেও ডাকতো। আদর্শ স্কুলে পড়তো। আমাদের গ্রামের প্রায় সবাই আদর্শ স্কুলে পড়তো। কেউ কেউ রিভার ভিউ স্কুলেও পড়তো। আমরা কয়েকজন মানে আমি, এনামুল, মিলন আর লিটু শুধু বয়েজ স্কুলে পড়তাম। তখন বয়েজ স্কুলে চান্স পাওয়া ছিলো খুবই টাফ। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছিল খুবই কঠিন। তাছাড়া অভিভাবকরা পড়ানোর চিন্তাও করতে পারতো না। আর্থিক সীমাবদ্ধতা একটা বড় বাঁধা ছিলো। মূলত আথির্ক টানাপোড়েনের কারণেই হাটিরপাড়ে ঝগড়া লেগেই থাকতো। তবুও সবাই চেষ্টা করতো সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করার। খেলাধুলা করার কারণে নিয়মিত মার খেতে হতো গ্রামের ছেলেদের। এমনকি খেলাধুলা নিয়ে এক অভিভাবক আর এক অভিভাবকের সাথে ঝগড়া করতো। আমরাও যে মার খাই নি বিষয়টি তেমন নয়। একবার এসএসসি পরীক্ষার আগে ঘরের ভেতর পড়ছিলাম আমি। দরজা বন্ধ ছিলো। জানালাগুলো ছিলো খোলা। জানালায় কোনো গ্রিল ছিলো না। শাহীনুর নামে এক বন্ধু এসে আমাকে ক্রিকেট খেলতে ডাকলো। ওদের টিমের হয়ে ক্ষ্যাপ খেলতাম আমি। তাছাড়া খেলার কথা শুনলে স্থির থাকতে পারতাম না আমি। ও ডাকার পর সুযোগ খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালানো ছিল মুশকিল। তাই বাধ্য হয়েই নি:শব্দে জানালা দিয়ে পালালাম। সন্ধ্যায় ঘেমে একাকার হয়ে বাসার কাছে আসতেই দেখি বাবা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাঠি দেখামাত্রই আমি দৌড় দিতেই আমার পিছু পিছু দৌঁড়ালেন বাবা। আমাকে ধরে কিছু না বলে বরং জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, পরীক্ষার আগে খেলতে যাস যদি হাত পা ভাঙে তখন কি হবে বল। অনবরত বোঝানোর চেষ্টা করতেন আমাকে। চুপ করে থাকতাম আমি। ভুল বুঝতে পেরে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতাম আর খেলবো না। অন্তত পরীক্ষার আগে তো না। সময়টা তখন ১৯৯৮ এর। এসএসসি পাশ করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই। কিছুদিন ক্রিকেট খেললেও পড়াশুনার চাপে আর খেলা হয় না। তারপর বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি হয় গ্রামের বন্ধুদের সাথে। বাবু ভাই, মজনু ভাই, বোনো চাচা, রিজু, উজ্জ্বল এবং লাভলুসহ আরো যারা ছিল তাদের সাথে। এরই মাঝে গ্রামের মানচিত্রেও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণ হতে থাকে। নতুন নতুন ক্লিনিক বহুতল ভবন গড়ে ওঠে। আমি শুধু ছুটির সময় বাসায় আসি। স্কুল কলেজের পুরাতন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই। শহরের পরিবর্তন কিম্বা খেলার বন্ধুদের পরিবর্তন ততটা খেয়াল করি না। আসলে বাস্তবতার কারণে খেয়াল করা সম্ভব হয় না। ২০১৩ সাল। লালমনিরহাট থেকে বদলী হয়ে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করি। নিজ বাড়ি থেকে কলেজে যাতায়াতের কারণে ততটা ব্যস্ততা ছিল না। তাই বিকেলে ঈদগাহ মাঠে খেলা শুরু করি। জুনিয়রদের সাথে ক্রিকেট খেলি। বয়সের ব্যবধান বেশি হলেও বিষয়টা আমলে নেই না। পরে আমার সাথে যোগ দেয় বাল্য বন্ধু হেলাল। ও নিজেও কলেজ শিক্ষক। খেলতে গিয়ে বাবু ভাইদের মতো খেলোয়াড়ও পাই। অবলীলায় অতীতের কথাগুলি মনে পড়তে থাকে। মনে পড়ে বাবু ভাই, মজনু ভাই, বোনো চাচা, উজ্জ্বল, রিজু ও লাভলুদের কথা। বাবু ভাইদের বাসা আমাদের বাসার পাশেই। উনি পৌরসভার কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। সেটি আগে থেকেই জানতাম আমি। রাস্তা ঘাটে দেখা হওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো কথোপকথন। কেমন আছি, কোথায় যাচ্ছি ইত্যাদি। তবে ওনার পূর্বের চেহারা আর বর্তমানের চেহারার মধ্যে পার্থক্য দেখে অবাক হই। মুখে নেই সেই লাবণ্য, শরীরে নেই তরতাজা ভাব, হাস্যোজ্জ্বল প্রতিচ্ছবিটিও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বিয়ে করেছিলেন ত্রিমোহনীতে। ওনার শ্যালক পড়তো পলিটেকনিকে। তার কাগজ পত্র সত্যায়িত করার জন্য বাবু ভাই আসতেন আমার কাছে। রাস্তায় দেখা হলেই বলতেন, মোনা, মোর শালার কাগজগুলা যে সত্যায়িত করা লাগবে। কখন বাড়িত থাকপু বল।’ কথাগুলি বলার সময় চরম অসহায়ত্ব ফুটে উঠতো বাবু ভাইয়ের চোখে মুখে। আমার খারাপ লাগতো। অবলীলায় তার মিডফিল্ড থেকে গোল করার দৃশ্য চোখে ভেসে উঠতো। আমি বলতাম, আপনার যখন ইচ্ছে তখনই আসবেন। আমি যদি নাও থাকি আমার পড়ার রুমে কাগজ রেখে যাবেন। আমি সত্যায়িত করে রাখবো।’ আমার কথা শুনেই বাবু ভাই ভরাট হাসি দিতেন। আমি মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করতাম শৈশবের হাসির সাথে তার বর্তমানের হাসির। কিন্তু দেখতে পেতাম দুই হাসির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। এই হাসিতে নেই সেই হাসির মতো উচ্ছলতা। নেই ভরপুর সতেজতা। একদিন সকাল বেলা পড়ছিলাম। হুড়মুড় করে বাবু ভাই আমার ঘরে আসলেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, মোনা, ঘরোত আছিস।’জি¦ বাবু ভাই, আছি।’ চেয়ারে বসা অবস্থায়ই আমি উত্তর দিলাম। কি কারণে এসেছে আমি বুঝতে পেরে ভেতরে বসতে বললাম। এর মাঝে আমার টেবিলে নাস্তা দিয়ে গেলেন খালা। আমি দুটো রুটি বেশি করে দিতে বললাম। সাথে ডিম ভাজি ও সবজি। জোর করে খাওয়ালাম বাবু ভাইকে। আর দেখতে থাকলাম তাকে। কথা বললাম নানা বিষয়ে। প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসলো বোনো চাচার কথা। উনি কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে উঠলেন বাবু ভাই- ‘কেন তুই জানিস না, বোনো চাচা মারা গেছে! ‘না তো।’ বিস্ময় নিয়ে বললাম আমি বাবু ভাইকে। ‘মারা যাওয়ার সময় নাকি ভাবীর হাত ধরে জোরে জোরে কইছিলো আমাক বাঁচা বউ। আমাক বাঁচা।’ আবার বললেন বাবু ভাই। ‘কি হইছিল ওনার বলতে পারেন? আমি উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। ‘সঠিক বলতে পারবো না। বিপ্লবকে জিজ্ঞেস করিস। ও তো অল টাইম ছিলো। আর বিপ্লব তো প্রায় প্রায়ই ওর গ্যারেজে বসে থাকতো।’ ‘ ঠিক আছে বাবু ভাই। আমি এক্ষুণি জিজ্ঞেস করছি। কি সাংঘাতিক ব্যাপার রে বাবা।’ ‘আচ্ছা মোনা থাক, আমি আসি।’ এই বলে বাবু ভাই বিদায় নিলেন আমার কাছ থেকে। বাবু ভাই চলে যেতেই আমি বিপ্লব ভাইয়ের রুমে চলে আসলাম। জিজ্ঞেস করলাম বোনো চাচার কথা। ‘মারা যাওয়ার বেশি দিন তো হয় না। তুই তো ছিলি না তখন বাসায়। পরে যে বলবো মনে নাই। টেনশনে টেনশনে অবস্থা খারাপ হইছিল। মজনুর খবর জানিস। ওরও তো সমস্যা।’ বিপ্লব ভাই স্বাভাবিকভাবেই বললেন। ‘কি সমস্যা ভাইয়া? ‘সম্ভবত লিভার সিরোসিস। এই অবস্থাতেও গাড়ী চালায়। ঢাকার রাস্তার যে অবস্থা। তাও চালায়। কি করবে সংসার তো চলে না। সময় পেলে দেখা করিস।’ সত্যি বলতে মজনু ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হয় নি। দেখা করবো করবো বলে আর দেখা করা হয় নি। তবে ওনার ফুফুর কাছ থেকে শারীরিক অবস্থার কথা শুনতাম। হঠাৎ একদিন শুনি মজনু ভাই আর নেই। নিজের কানকে বিশ^াস করতে পারি নি। এত দ্রæত বিদায় নেবে কল্পনাও করি নি। বিশেষত দেখা করতে না পারার আক্ষেপটা এখনও রয়ে গেছে। কিছুদিন আগেই মজনু ভাইয়ের বউ এসেছিল তার মেয়েকে নিয়ে। কোথায় প্রাইভেট পড়াবে, কোন কোচিংয়ে ভর্তি করাবে এ সব বিষয়ে। পরে একটা কোচিংয়ে আমি নিজে গিয়ে ভর্তি করে দেই। মজনু ভাইয়ের মেয়ে যতক্ষণই আমার সাথে ছিলো একটা ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছিল আমার ভেতরে। ছটফট করছিলাম এই ভেবে- কেন যে দেখা করলাম না! এরপর একটু চোখ কান খোলা রাখি। শৈশবের বন্ধুরা কে কি করছে জানার চেষ্টা করি। অনুমানের বেশির ভাগই সত্যি হয়। প্রায় সবাই বাসের ড্রাইভার, হেলপার, কণ্ট্রাকটর, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রী, ক্লিনিকের বয় অথবা অফিসের পিয়ন। এর মাঝে একদিন বি.আর.টি.সি কাউন্টারে যাই। রাজশাহী যাব বলে টিকিট কাটার জন্য। ওখানে দেখা হয় রিজুর সাথে। কথা হয় অনেকক্ষণ। একসাথে চা খাই। বাবু ভাইয়ের মতোই রিজুর অবয়বেও দেখতে পাই না পূর্বের লাবণ্য। শুকিয়ে অনেকটা কাঠ হয়ে গেছে। তবুও আচরণে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা। বয়স ত্রিশ পেরুলেও বিয়ে করে নি। বলতে গেলে কেউ পছন্দ করে নি ওকে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আগের থেকে বেড়েছে। একাকীত্ব যে সেই প্রতিবন্ধকতাকে দ্বিগুণ করেছে সেটিও বোঝা যাচ্ছে। তাছাড়া ফরিদ ভাইয়ের মৃত্যু মানে রিজুর বাবার আকস্মিক মৃত্যুও ওকে করে তুলেছে নি:সঙ্গ। হঠাৎ করেই ফরিদ ভাই যেদিন মারা যায় সেদিন কুড়িগ্রামেই ছিলাম আমি। জানাজায় গ্রামের অনেকই ছিলো। তবে তার প্রতি তরুণদের ভালোবাসা দেখে অবাক হয়েছিলাম। রীতিমতো কান্নার বন্যা বইয়ে দিয়েছিল সবাই। এর পর খুব বেশি দিন হয় নি। প্রতিদিনের মতো বিছানায় শুয়েছিল রিজু। কিন্তু সে শয্যাই যে শেষ শয্যা হবে কেউ ভেবেছিল কি? দু:খ, কষ্ট, অভিমান আর যন্ত্রণার ক্ষত নিয়ে দিন কাটানো রিজু ঘুমিয়েছিল চিরদিনের মতো। কিভাবে বিশ্বাস করা যায় এমন আকস্মিক মৃত্যুর খবর? তাও আবার এত অল্প বয়সে। মুহূর্তেই শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম আমি। ভেসে উঠছিলো রিজুর মায়াবী মুখচ্ছবি। আমাকে যেন শাসিয়ে বলছিলো, মন্জু চাচা, তুমি বল তুলে মারতে পারো না কেন? তোমার ট্রেনিং লাগবে। আর জোরে হাঁটো। এত আস্তে হাঁটলে হবে। পায়ে বল না থাকলে খেলবে কীভাবে? জোরে হাঁটো।
কোমল রিজুর অস্বাভাবিক মৃত্যুতে একটা বড় ধাক্কা পাই। ধাক্কাটা আরো বেড়ে যায় বিপ্লব ভাইয়ের এ্যাকসিডেন্টে। ভাই তখন চাকরি করতেন ঠাকুরগাঁয়ে। প্রতি সপ্তাহে কুড়িগ্রাম থেকে ঠাকুরগাঁয়ে যেতেন। সেদিন ছিল ২৮ ডিসেম্বর। আমার জন্মদিন। বাসায় একায় ছিলাম। শরীরটা ভাল বোধ হচ্ছিল না। সন্ধ্যাায় হাঁটতে বেরুবো এমন সময় একটা বিপ্লব ভাইয়ের নম্বর থেকে কল আসে। প্রথমবারে ধরতে পারি না। দ্বিতীয়বারে ধরি। ‘আপনি কি এই নাম্বার যার তার ভাই।’ অপরিচিত একজন বলেন। ‘জ¦ী। আমি উত্তর দেই। কিন্তু কেন বলুন তো ভাই।’ ‘আপনার ভাই দিনাজপুরের দশমাইলে এ্যাকসিডেন্ট করছে। ট্র্যাক এসে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে। আমরা কি দিনাজপুর মেডিক্যালে নিয়ে যাবো? এক নি:শ্বাসে বলে যান উনি। ‘এক্ষুণি নিয়ে যান। আমি আসছি।’ দ্রæত সময়ের মাঝেই ভাবী,আমি, রনজু ভাই, ও বন্ধু কাজল যাত্রা করি। ওদিকে আমার ছোট বোন নবাবগঞ্চ উপজেলা থেকে রওয়ানা হয়। ট্রাকের ধাক্কার কথা শুনেই আতঙ্ক বেড়ে যায় আমাদের। মাথায় আঘাত পেয়েছিল কিনা ভালো করে শোনার চেষ্টা করি। দিনাজপুরে এসে পায়ের অবস্থা দেখে মুষড়ে পড়ি। কি করবো ভেবে পাই না। অত:পর ডাক্তারের পরামর্শে ঢাকায় নিয়ে যাই। অপারেশন, আই.সি.ইউ, সি.সি.ইউ, ফার্মেসী, অর্থের সংস্থান সব কিছু করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠি। একা একা সামলানো অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। উপরন্তু ফোন রিসিভ করতে করতে অস্থির হয়ে যাই। পরে রনজু ভাই, গনি ভাই ও নাহিদ আসে। বিপ্লব ভাইয়ের বন্ধুরা অনবরত খোঁজ নিতে থাকে। চিশতী ভাইসহ ঢাকায় যারা থাকে তারাও দেখতে আসে। হক গাড়ির হেল্পার রাজু ভাইও দেখা করতে আসে। বিপ্লব ভাইয়ার সাথে আমার একটা পার্থক্য স্পষ্টতই লক্ষ করি আমি। শৈশবে যারা যারা আমাদের সাথে খেলাধুলা করতো তাদের সবার সাথেই যোগাযোগ রয়েছে বিপ্লব ভাইয়ের। আমি বিমোহিত হই। আর বুঝতে পারি তাদের যোগাযোগটা স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং অকৃত্রিম ভালোবাসায় প্রোথিত। ভাইয়াকে নিয়ে যখন লালমনিরহাট স্টেশনে আসি ওকে রিসিভ করতে আসে ওর বন্ধুরা। তাদের মধ্যে কুদ্দুস ভাই অন্যতম। বন্ধুকে সুস্থ দেখে খুশির পাশাপাশি ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন কুদ্দুস ভাই। তার মুখের চওড়া হাসির কাছে হার মেনে যায় চোখের জল। অদ্ভুত এই সৌন্দর্য উপভোগ করি আমি। বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে আসে আমার। কুদ্দুস ভাই হাটিরপাড় ফুটবল টিমে খেলতেন না। উনি খেলতেন হাসপাতাল পাড়া ফুটবল টিমে। আসলে তখন ঘোষপাড়া, হাটিরপাড়া এবং হাসপাতাল পাড়া মিলে কয়েকটি মাঠ ছিলো। তাই এলাকার দূরত্ব কম হওয়ার পরেও অনেকগুলি দল ছিল। এখন তো তিন এলাকা মিলে একটা মাঠও নেই। খেলতে যেতে হয় ঈদগাহ মাঠ নয়তো গভর্মেন্ট স্কুল। ফুটবল না খেললেও কুদ্দুস ভাইয়ের সাথে ক্রিকেট খেলেছি আমি। খেলেছি হাসপাতাল পাড়ার হাবিব ভাই, হিল্লোল ভাই, সোহান ভাই, হামিদ ভাই, শান্ত ভাই ও বাবু (ছোট বাবু) ভাইদের সাথে। প্রায় সমবয়সী আনোয়ার, ফেরদৌস, হাকিম, আলমগীর ও ইকবালদের সাথে খেলার কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। সদর হাসপাতালের ভেতরেই আমরা খেলতাম। এখনকার মূল ভবনটিতে। মনে আছে কুদ্দুস ভাইয়ের লাফিয়ে লাফিয়ে বল করার দৃশ্য। তখন খেলার মাধ্যমেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠতো আমাদের। বিপ্লব ভাই তখনও সুস্থ হয়ে উঠেন নি। একটি পা অপারেশনের মাধ্যমে কেটে ফেলা হয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শে ডান পা নিয়েই বেডরেস্টে আছেন। তারপরও কুদ্দুস ভাই, রাজু ভাইরা বাসায় এসে ধরে ধরে নিয়ে যেতেন বিপ্লব ভাইকে। হাসপাতালের সামনের দোকানগুলোতে বসে গল্প করতেন। দীর্ঘ সময় পেরুনোর পর আবার বাসায় দিয়ে যেতেন। তখন ছিলো বসন্তের শুরু। কৃষ্ণচূড়া আর শিমুলে ছেয়েছে প্রকৃতি। মোহনীয় রূপে সেজেছে কুড়িগ্রাম শহর। মিষ্টি রোদ পড়ে বাড়ির ছাদগুলোতে। হাটিরপাড়ের অতীত হয়ে যাওয়া উঠান। পায়ের ক্ষত শুকানোর জন্য দোতলার ছাদে বসতেন বিপ্লব ভাই। একইসাথে উপভোগ করতেন বসন্তের অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। ছাদ থেকেই হঠাৎ আমাদের চিৎকার করে ডাকলেন। আমরা ভয় পেলাম। দ্রæত উপরে গেলাম। তিনি যে সংবাদ দিলেন তার জন্য কেউই প্রস্তত ছিলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে বললেন, কুদ্দুস আর নেই রে। হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেল। এত করে বলতাম টেনশন করিস না আমি আছি। শুনে থ হয়ে গেলাম আমরা। নিজের গায়ে চিমটি কেটে নিজের অস্তিত্ব অনুভবের চেষ্টা করলাম আমি। শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচল যেন বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো আমার। কুদ্দুস ভাইয়ের অপ্রত্যাশিত বিদায়ে বসন্তের সৌন্দর্য যেন হারিয়ে গেলো পুরো গ্রাম থেকে। হাসপাতাল পাড়ার ক্রিকেটার বাবু ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন হাটিরপাড়ের জানু ভাই। খেলার সময় জানু ভাই হাসপাতাল পাড়া ক্রিকেট দলের সাথে থাকতো বলে আমরা তাকে ক্ষেপাতাম। বিপরীতে কখনোই ক্ষেপতেন না তিনি। প্রবল ধৈর্য ও সরলতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। মাথা নিচু করে হাঁটতেন সবসময়। কখনো উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখি নি তাকে। পড়াশুনায় ছিলেন গভীর মনোযোগী। কখনো স্কুল ফাঁকি দিতেও দেখি নি আমরা জানু ভাইকে। ঠোঁটের কোনে সবসময়ই হাসি লেগে থাকতো তার। ধবধবে ফর্সা ছিলো মুখখানা। তার নির্মল চোখের চাউনি অনায়াসেই ফুটিয়ে তুলতো মননের পবিত্রতা। আমাদের মননেও জাগাতো বিশেষ মুগ্ধতা। দুভার্গ্যবশত বাস্তবতার কারণে আর স্থায়ী হয় নি সেই মুগ্ধতা। চল্লিশের নিচে তিনিও পরাজিত নিয়েছিলেন মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে। চাকরি করতেন একটি এনজিওতে। নিজেকে সময় দেবার মতো সময়ই পান নি। যখনই দেখা হতো দেখতাম হয় অফিস থেকে বাড়িতে আসছেন অথবা অফিসে যাচ্ছেন। বেতন পেতেন খুব সামান্য। সেটি যাতে বাড়ে সে আশাতেই পরিশ্রম করেছিলেন। চাকরি করেছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতটাই ব্যস্ত ছিলেন আজ দেখাবে কাল দেখাবে করতে করতে অসুখ চাপিয়ে রেখেছিলেন। হজমের সমস্যা ছিলো। অফিসের চাপে ঠুনকো হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ব্যক্তিগত জীবনকে আগলানোর বিষয়টি। তাছাড়া অর্থের তো একটা ব্যাপার ছিলোই। আশা করেছিলেন যদি এমনিতেই সেরে যায়। দু:খজনকভাবে রোগ না সেরে বরং বেড়েই চলেছিল। এত দ্রত যে বাড়বে তা কে জানতো। একদিন সাক্ষাতে অসুখের কথা জিজ্ঞেস করতেই জানু ভাই বলেছিলেন,হজমে খুব সমস্যারে ভাই। আর পেটে ব্যথা উঠলে দুনিয়ার কোনো খবর পাই না। ছটফট করতে থাকি। এত নিয়ম মানছি কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।’ এর কিছুদিন পর জানু ভাইয়ের অবস্থা আরো খারাপ হয়। চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের ভেলোরো। সুস্থ হয়ে আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন জানু ভাই, এ আশায় অপেক্ষা করতে থাকি আমরা। কিন্তু সে আশা আর পূরণ হয় না। চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় জানু ভাই।
মানুষের জীবন যে এত ঠুনকো হতে পারে বাস্তবে উপলব্ধি করি সেদিন। তারপর থেকে অতীত যেন আরো কাছে আসতে থাকে আমার। দেখতে পাই হাটিরপাড়, হাসপাতাল পাড়া এবং ঘোষপাড়া থেকে জমি বিক্রি করে চলে গেছে অনেকে। শহরের সাথে তাল মিলিয়ে টিকে থাকতে পারে নি তারা। বাধ্য হয়েই জন্মভূমি ছেড়েছে। আর যারা এখন আছে তারাও কোনোরকমে টিকে রয়েছে। এমন অবস্থা ছিল বাবু ভাইয়ের। সংসারের আর্থিক সংকটের কারণে দিগি¦দিক ছুটতে দেখি তাকে। তবে কখনো বলার সুযোগ পাই নি। তাছাড়া বাবু ভাই নিজেও আড়াল করতে চেয়েছিল বলে আগ বাড়িয়ে আমি বলিনি। ব্যস্ততার কারণে আসলে এত কিছু ভাবার সময়ও পাওয়া যায় নি। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম বাবু ভাই অসুস্থ। তার বাসার কাছে যেতেই শুনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সন্ধ্যার পর দেখতে যাব বলে স্থির করলাম। কিন্তু সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে পেলাম না। পথেই শুনতে পেলাম সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। সেই মুহূর্তে আর বাসায় গেলাম না। পরে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। কয়েকদিনের মধ্যে উনিই আবার আমার কাছে আসলেন। শ্যালকের কাগজগুলি সত্যায়িত করতে। আমি সত্যায়িত করে তার শরীরের খবর নিলাম। ঠিক মতো বলতে না পারায় রির্পোটগুলি আনতে বললাম। রিপোর্ট পড়ে আশ্চর্য হলাম। হার্টে কয়েকটি বøক রয়েছে। বিষয়টা ওনাকে বোঝালাম। অপারেশনের পরামর্শ দিলাম। বাড়ি ভিটে বিক্রি করে হলেও যেন সেটি করেন তার গুরুত্ব বোঝালাম। রংপুরের ভালো ভালো ডাক্তারের কথাও বললাম। পরে উনি গিয়েছিলেন কিনা জানতে পারি নি। কিন্তু যখন জানতে পারলাম বুকের ব্যথা নিয়ে উনি আবারো হাসপাতালে ভর্তি তখন হাসপাতালের পথে রওয়ানা হলাম। কিন্তু এ যাত্রায় আর কোনো লাভ হলো না। শেষ দেখাটাও দেখতে পারলাম না। হার্ট এ্যাটাক করে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন বাবু ভাই। এক সময়ের হাটিরপাড়ের দুরন্ত তরুণ। মিড ফিল্ড থেকে এক কিকে গোল করা বাবু ভাই। শুয়ে আছেন খাটলিতে। তার ছোট্ট সন্তান খাটলির চারিদিকে ঘোরাফেরা করছে। মাঝে মাঝে বাবু ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। হয়ত প্রত্যাশা করছে বাবা খাটলি থেকে এখুনি উঠে এসে ওর গলায় চুমু দেবে। বাবু ভাইয়ের মুখ খোলা। নাকে সাদা তুলো দেয়া। গোলাপ জলের সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। শেষবারের মতো দেখতে থাকি আমি বাবু ভাইকে। বুকে এক সমুদ্র ব্যথা নিয়ে। ভাবি, আর কখনো, কোনোদিনও বাবুভাই আর বলবে না আমাকে, মোনা, মোর শালার কাগজগুলা যে সত্যায়িত করা লাগবে। কখন থাকপু বাড়িত বল।’ বাবু ভাইয়ের মৃত্যু গ্রামের সবার বুকের ভেতরে একটা মোচড় দিয়ে যায়। প্রবলভাবে আহত হয় সবাই। একের পর এক তরুণদের অকাল মৃত্যুতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে হাটিরপাড় গ্রাম। ক্লান্তিকর এ মুহূর্তে হাটিরপাড় গ্রাম মনে করিয়ে দেয় অনেক আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া বাবু দাদার কথা। সরল মনের দীর্ঘদেহী বাবুদা। দেখেছিলাম মৃত্যুর পূর্বে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল বাবুদা। অথচ এই মানুষটির স্থুল দেহ দেখে প্রথমে ভয় পেতাম আমরা। এরপর আমরা আর কাউকে দেখি নি তার মতো করে হেলে দুলে হাঁটতে। এত দীর্ঘ দেহ নিয়ে ফুটবল খেলতে। বাবুদার বাবা মৃণাল কাকা মুদির দোকান চালাতেন। দোকানটি ছিলো ঘোষপাড়ার প্রাণকেন্দ্রে। পরবর্তীতে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় ধীরে ধীরে ব্যবসায় ভাটা পড়তে থাকে তার। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তাদের চরম অনিশ্চয়তায়। এর পর দীর্ঘ একটা সময় কারো অকাল মৃত্যু হয় না। তবে করোনার কারণে গ্রামের কয়েকজন চাকরি হারিয়ে ঢাকা ছেড়ে হাটিরপাড়ে আসে। বিষয়টা লক্ষ করি আমি। তাদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতাও দেখতে পাই। একজন তো একদিন বলেই ফেলে, ‘মনজু ভাই, কি হবে আমার। একটু দেখেন তো কলেজে কোনো ফাঁক টাক আছে নাকি ঢোকার।’ মিথ্যে আশ্বাস দেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না আমার। অবশ্য দুজন মহিলাকে দুটো বাসায় কাজ নিয়ে দিতে পারি আমি আমার কলিগের বাসায়। এ মহিলাগুলো যে কারো বাসায় কাজ করবে কখনো ভাবতে পারি নি আমি। অবশ্য কঠোর বাস্তবতার কাছে অনেক ভাবনারই তো সমাধি হয়। আমরা যা ভাবি না তাইই ঘটে। এ সময়টাতে রংপুর কুড়িগ্রাম মিলে অবস্থান করি আমি। সেদিন ছিলাম রংপুরে। সম্ভবত শনিবার। ফেসবুক খুলেই দেখি লাভলুর মৃত্যুর খবর দিয়ে পোস্ট। আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারি না। বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট লাভলু। পৌরসভায় একটা চাকরি করতো। অস্থায়ী ভিত্তিতে। চাকরিটা চলে গেলে একটা হোটেলের ম্যানেজারি শুরু করে। কিন্তু করোনার সময় হোটেল ফাঁকাই থাকতো। ওর মা আমাদের বাসায় নিয়মিতই আসতেন। বলতেন হামার লাভলুর কি হবে বাবা। ‘পৌরসভাত যখন ছিলো ভালোই ছিলো। এলা তো অবস্থা খুবই খারাপ।’ আমি ফেসবুকে পোস্টটি পুনরায় ভালো করে দেখতে থাকলাম। আসলেই লাভলু কি না। মেয়েকে কোলে নিয়ে লাভলুর দেয়া ছবি দেখে বরফের মতো হিম হয়ে গেলাম। ছবির উপরে লেখা রয়েছে-শুক্রবার ভোরবেলা হাটিরপাড়ের লাভলু রংপুর মেডিক্যালে যাবার পথে মারা গেছে।
পরদিন ওদের বাসায় গেলাম। দুপুর বেলা। ওর জন্য দোয়ার আয়োজন ছিলো। লাভলুর মা আমাকে দেখেই কান্না ছেড়ে দিলো। বুকের ভেতর একটা চাপ অনুভব করলাম। স্বাভাবিক হয়ে সবার সাথে কথা বললাম। অনেককেই দেখতে পেলাম। বন্ধু এনামুলও ছিলো। ওর সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে মনে পড়লো উজ্জ্বলের কথা। এনামুলকে জিজ্ঞেস করতেই প্রায় সবাই বলে উঠলো-উজ্জ্বল মারা গেছে তুই জানিস না। কিডনির সমস্যা হইছিলো। রাজপুত্রের মতো চেহারার উজ্জ্বলের মৃত্যুর কথা এভাবে শুনতে হবে ভাবিনি। নিজের ভেতর প্রচÐ অপরাধবোধ কাজ করছিলো। তাই উজ্জ্বলের মা বেঁচে আছে কিনা জিজ্ঞেস করার আর সাহস পেলাম না। অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে বাসার দিকে হাঁটতে থাকলাম। আমাদের দেশে যদি স্বাস্থ্যবীমা থাকতো। শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষদের জন্য যদি ফ্রি চিকিৎসা থাকতো। তাহলে হয়তো এই অকাল মৃত্যুগুলো হতো না। বিনা চিকিৎসায় তাদের পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হতো না। লাভলুসহ সবার বাচ্চাগুলোর কি হবে ভাবতেই আঁতকে উঠলাম। কে নেবে এদের দায়? গাড়ি চালিয়ে, দালান গেঁথে, ফাইল টেনে এরাও তো কাজ করেছিলো আমাদের দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। এসব ভাবতে ভাবতেই বাসার পথে হাঁটতে থাকলাম আমি। অবলীলায় উজ্জ্বলের মায়ের মুখখানি ভেসে উঠতে থাকলো। কি পরম মমতার সাথে রাস্তা ঝাড় দিতেন তিনি। কতটা নিষ্ঠার সাথে আমাদের নোংরা করা আবর্জনাগুলি পরিস্কার করতেন। ঝকঝকে নির্মল রাখতেন আমাদের শহর। এই মুহূর্তে তার মৃত্যুর খবর যেন শুনতে না হয় সেটিই কামনা করছি। আর লম্বা পা ফেলে হাঁটছি। প্রচÐ উদ্বেগে গা ঘেমে যাচ্ছে আমার। ভাবনাগুলিও অস্বচ্ছ হয়ে পড়ছে। আকাশের দিকে তাকালাম। এ মুহূর্তে নেই তার ঝলমলে রূপ। নেই বিন্দুমাত্র নির্মলতা। শুধু মনে হলো শকুন আর কাকেদের চিৎকার। বহুতল ভবনগুলির উপর থেকে অনবরত চিলাচ্ছে ওরা। এবার একদম বাসার সামনে আসলাম আমি। দূর থেকে দেখতে পেলাম রান্নাঘরে কাজ করছেন ফুফু। ফুফুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম উজ্জ্বলের মায়ের কথা। আমার প্রশ্ন শুনেই মুখ শুকিয়ে গেল ফুফুর। কি চুপ করে গেলেন যে ফুফু বলেন। ‘কি আর কবো বাবা, উজ্জ্বলের মাও তো অনেকদিন হলো মারা যাওয়ার। তোমরা জানেন না। খুব কষ্ট নিয়ে মারা গেছিলো ওর মা। পরে তো মায়ের শোকে শোকে উজ্জ্বলও মারা গেলো। কি সুন্দর ফুলের মতো ছিলো ছোয়াটা।’ বাস্তব জীবনের ওপর রচিত গল্পটা এখানেই শেষ হতো পারতো। কিন্তু হলো না। পুনরায় আর একটি মৃত্যুর খবর শুনতে হলো। অকাল মৃত্যু। ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। শেষবারের মতো সকালবেলায় প্রæফ করছিলাম গল্পটি। হঠাৎ লালমনিরহাট থেকে কল আসলো দিপ্তীর। বললো, বৃষ্টি আর নেই স্যার। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম আমি। সাক্ষাতে কথা হবে দিপ্তী। এই বলে মোবাইল রেখে দিলাম। শক্তি, দিপ্তী, দ্বিতীয়া, বৃষ্টি, কেয়া, সুমি। ওরা ছয় জন। আমার কাছে পড়তো। প্রতীতির নিয়মিত শিক্ষার্থী ছিলো ওরা। কোচিংয়ে পড়ার সামর্থ্য ছিলো না। সে কারণেই আমার কাছে পড়তো। দীর্ঘদিন পড়েছিল। পরিবারের সদস্যের মতোই ছিলো ওরা। ২০১০ থেকে ১৩, ১৪ সাল পর্যন্ত পড়েছিল। আর্থিকভাবে দুর্বল হলেও মনগুলি ছিলো ওদের আকাশের মতোই উদার। ওদের ব্যবহারে মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিলো না। পড়তোও মনোযোগ দিয়ে। যা পড়তে বলতাম তাই পড়ে আসতো। পড়তো নানা ধরনের বই। আজও সেই অভ্যেস ধরে রেখেছে। কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সবাই আজ স্বাবলম্বী। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। শুধু ব্যাংকে জব করে দ্বিতীয়া। ওদের ছয়জনের মাঝেই সম্পর্ক ছিলো গাড়। শিক্ষক হিসেবে এমন শিক্ষার্থী পাওয়া যেমন সৌভাগ্যের তেমনি গৌরবের। এত শ্রদ্ধা করতো ওরা যা ভাষায় প্রকাশ করা আমার সাধ্যাতীত। বৃষ্টির বাড়ি হরিকেশে। হাটিরপাড় থেকে কাছেই। আগে তো ঘোষপাড়ায় দাঁড়ালেই হরিকেশ দেখা যেত। মাঝখানে তো কোনো বিল্ডিংই ছিলো না। গোরস্থান কিম্বা মাঠের স্কুল পেরিয়ে অল্প সময়েই যাওয়া যেতো। বৃষ্টির বাবা মা উভয়ই বয়স্ক। দায়িত্ব নেয়ার সক্ষমতা নেই তাদের। দুই ভাই। বড় ভাই কৃষক। এবং ছোট ভাই ড্রাইভার। শ্রমজীবী হওয়া সত্তে¡ও বোনকে সাপোর্ট দিয়ে আসতেন। বৃষ্টিও ছাত্র জীবন থেকেই প্রাইভেট পড়িয়ে যতটা পারতো নিজের খরচ চালাতো। হেঁটে হেঁটেই শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাতায়াত করতো। দীর্ঘ সময় পেরুলেও যখন চাকরি হচ্ছিলো না তখন ভেঙে পড়ছিলো। এমনিতেই ওর অসুখ লেগে থাকতো। সামান্য টেনশনেই প্রচুর ঘেমে যেতো। খাওয়ার রুচিও ছিলো অনেক কম। অর্থাভাবে প্রাইভেটলি ডাক্তার দেখাতে পারতো না। হাসপাতালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখাতো। ডাক্তার দেখানোর পর বাসায় যেতো না। হাঁপাতে হাঁপাতে আসতো প্রাইভেটে। মানসিক শক্তিতে ও ছিলো অদম্য। যত কষ্টই হোক আমাকে একটা চাকরি নিতেই হবে স্যার। নিয়তই এ কথা বলতো। গুছিয়ে কথা বলার দক্ষতাও ছিলো অসাধারণ। প্রতীতির অনুষ্ঠানগুলোতে বক্তৃতা দিতো নান্দনিক দ্যোতনায়। অনুষ্ঠান আয়োজনে কাজও করতো মন দিয়ে। এছাড়াও টি. আই. বি, রেড ক্রিসেন্ট থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোতে ওর ছিলো দৃপ্ত পদচারণা। ব্যক্তিগত প্রতিভা দিয়েই পারতো কিছু একটা করতে। কিন্তু সরকারি চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে শরীর কখন যে ভেঙে গিয়েছিল বুঝতে পারে নি ও। অথবা বুঝতে পারলেও আমলে নেয় নি। একটা সরকারি প্রজেক্টে চাকরি পেয়ে ফেনীতে গিয়েছিল। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে যখন মেয়েটা রেলে সরকারি চাকরি পায় তখন আর ওর খুশী দেখে কে? স্যার, একদিন সবাই মিলে আড্ডা দিবো আর আমার বেতনের টাকায় ইচ্ছেমতো মিষ্টি খাওয়াবো। অন্ত:সত্ত¡া ছিলো বলে আমরাই নিষেধ করি। পরে কোনো এক দিন খাওয়া যাবে বলে ওকে জানাই।
অফিসের কলিগরা অসম্ভব রকমের সহযোগিতা করে ওকে। ম্যাটারনিটি লিভ নিতে বললেও নেয় না বৃষ্টি। দীর্ঘ ছয় মাস বাচ্চাকে নিয়ে সময় কাটাবে বলে ছুটি নেয় না। কষ্ট করে হলেও নিয়মিত অফিসে যায়। একইসাথে অপেক্ষা করতে থাকে কাক্সিক্ষত মুহূর্তের। নারী জীবনের সর্বোচ্চ সার্থকতাকে স্পর্শের। সময় বাড়ার সাথে সাথে শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয় বৃষ্টির। সে জটিলতা একদিন প্রকট আকার ধারণ করে। রংপুরে নিয়ে যায় পরিবারের সদস্যরা। প্রত্যাশা করতে থাকে ভালো কিছুর। কিন্তু পেশেন্টের অবস্থা রিস্কি-ডাক্তারের এ কথায় ভেঙে পড়তে থাকেন তারা। হার মানার মতো মেয়ে নয় বৃষ্টি। মা হবার তীব্র বাসনাকে সফল করতে এবার মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকে ও। গ্রাহ্য করে না শারীরিক দুর্বলতাকে। জীবনের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে প্রসব করে একটি ফুটফুটে বাচ্চা। চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে সন্তানের মুখের দিকে। কিন্তু মৃত বাচ্চা ভেবে পরিবারের সদস্যরা তাকাতে দেয় না তাকে। এদিকে প্রসবের পরপরই শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দুর্বল হতে থাকে মায়ের। সমুদ্রের স্রোতের মতো জরায়ু থেকে ঝরতে থাকে রক্ত। টকটকে লাল রক্ত। অবস্থা অবনতির দিকে যাওয়ায় দ্রæত নেয়া হয় আইসিইউতে। সেখানেও চলে যুদ্ধ। বেঁচে থাকার যুদ্ধ। সুস্থ হয়ে সন্তানকে বুকে নিয়ে স্বস্তি পাওয়ার যুদ্ধ। শৈশব থেকে স্বস্তির পেছনে ছুটতে থাকা একজন অদম্য নারীর জীবনে আর স্বস্তির বৃষ্টি বর্ষিত হয় না। চোখের পাতা দুটো ধীরে ধীরে বুজে আসে। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি হ্রাস পেতে পেতে এক সময় এসে স্থির বিন্দুতে দাঁড়ায়।
গল্পকার: শিক্ষক, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম।